ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশের
কপ২৭ ডিব্রিফিং
ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বৈশ্বিকভাবে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ। সেই ধারাবাহিকতায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্ট মেম্বারস ক্লাবের এলডি হলে ‘কপ২৭ ডিব্রিফিং’ অনুষ্ঠিত হয়। ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশ এবং দ্য আর্থ সোসাইটির আয়োজনে অনুষ্ঠানটির সহযোগিতায় ছিল ব্রিটিশ হাইকমিশন, ঢাকা এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ডিআইইউ) এবং মিডিয়া পার্টনার হিসেবে ছিল দৈনিক ইত্তেফাক। অনুষ্ঠানে কপ২৭-এর মূল আলোচনা, প্রাপ্তি এবং বাংলাদেশের করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। কপ২৭-এর ফলাফল তুলে ধরতে ডিব্রিফিং অনুষ্ঠানটিতে নীতি-নির্ধারক, উন্নয়ন সহযোগী, জলবায়ুকর্মী, শিক্ষাবিদ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। কপ২৭-এর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে তাদের কাছ থেকে তাত্পর্যপূর্ণ প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়।
অনুষ্ঠানে কি-নোট স্পিকার হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি, বিদ্যুত্, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশ-এর চেয়ারম্যান ওয়াসেকা আয়েশা খান এমপি, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি, বাংলাদেশে নিযুক্ত ফরাসি রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপুয়, ব্রিটিশ হাইকমিশন ঢাকার ডেভেলপমেন্ট ডিরেক্টর ম্যাট ক্যানেল, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর পরিচালক প্রফেসর সালিমুল হক, ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশ-এর চেয়ারপাসন তানভীর শাকিল জয় এমপি,
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য (ডিপার্টমেন্ট অফ ইস্টিমেট) আহসান আদেলুর রহমান এমপি, কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আনোয়ারুল আবেদিন এমপি, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়) মীর মুস্তাক আহমেদ রবি এমপি, বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি মিনিস্টার কাউন্সিলর মাউরিজিও চিয়ান, বিদ্যুত্, শক্তি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুত্ বিভাগের মহাপরিচালক ইঞ্জি. মোহাম্মদ হোসেন, সুইডেন দূতাবাস ঢাকার হেড অফ কো-অপারেশন এবং ডেপুটি হেড অফ মিশন মারিয়া স্ট্রিডসম্যান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক অনুবিভাগের মহাপরিচালক ফাইয়াজ মুর্শিদ কাজী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের (জলবায়ু পরিবর্তন-১) যুগ্ম সচিব লুবনা ইয়াসমিন এবং জাতীয়, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন যুব সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ।
অনুষ্ঠানে বক্তারা কপ২৭-এর প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ভিত্তিতে ভবিষ্যতে বৈশ্বিক জলবায়ু-সম্পর্কিত কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেন। বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের পরিকল্পনা এবং এনডিসিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়েও আলোচনা হয়। পরবর্তী কপ সম্মেলনকে লক্ষ্য করে জলবায়ু তহবিল কাঠামো ও বিতরণ সম্পর্কিত কাজের কৌশলগত দিক এবং এতে বাংলাদেশের সম্পৃক্ততার সুযোগ নিয়েও আলোচনা করেন বক্তারা।
সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমালয়ের হিমবাহগুলোর অন্তত এক তৃতীয়াংশ গলে যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে যদি বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায়, তারপরও হিমালয় অঞ্চলের হিমবাহ গলা থামবে না। উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে গলে যাবে ৫০ শতাংশ হিমবাহ।’
ওয়াসেকা আয়েশা খান এমপি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় থাকা দেশের মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। গত এক দশকের তুলনায় জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির বিষয়ে এখন সচেতনতা অনেক বেড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তাতে আমরা দ্রুত সমাধান পাব।’
হাবিবুন নাহার এমপি বলেন, ‘উন্নত দেশের কারণে আমরা জলবায়ু বিষয়ক ক্ষয়-ক্ষতির মুখে পড়েছি। জলবায়ু সংকট সমাধানে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কী ভাবছেন তা নিয়ে বসে না থেকে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে। যদিও তারা তা করে দেখাচ্ছে। তবে, এ ক্ষেত্রে যথাযথ অর্থায়ন ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে।’
প্রফেসর সালিমুল হক বলেন, ‘বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ে এখন গোটা বিশ্বই চিন্তিত। কারণ এক হিসেবে দেখা গেছে, গত ১৫০ বছরে উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রের পানির স্তর বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। হিমবাহ ও বরফের স্তর গলে পানি হচ্ছে, আর সেই পানি গিয়ে মিশছে সমুদ্রে। তাই আমাদেরকে আরও সতর্ক হতে হবে।’
তানভীর শাকিল জয় এমপি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের অস্তিত্বের বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে তরুণরা সাহসের সঙ্গে কাজ করছে। তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি রোধ করতে শুধু অর্থ দিয়ে হবে না, প্রযুক্তিগত সহায়তারও প্রয়োজন আছে।’
মেরি মাসদুপুয় বলেন, ‘ফ্রান্স জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবেলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের জন্য একটি শক্তিশালী কাঠামো প্রদানের লক্ষ্যে বহুপাক্ষিক উদ্যোগের পক্ষে। যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতির মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিশ্বের সবচেয়ে সংবেদনশীল দেশগুলোর মধ্যে এক নেতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়।’
ম্যাট ক্যানেল বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কপ-২৭ এবং গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশের মধ্যে নীতিগত সম্পৃক্ততা, দক্ষতা ভাগাভাগি এবং অর্থায়নের ওপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্ব রয়েছে।’
শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি ইউএনএফসিসিসির জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি এবং ক্ষয়-ক্ষতি তহবিল আলোচনার বর্তমান অবস্থার সমন্বয়ের অভাবের জন্য সমালোচনা করেন এবং সুশীল সমাজ, নীতিনির্ধারক, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে কার্যকর যোগাযোগের জন্য সরকারের সহযোগিতার ওপর জোর দেন।
আহসান আদেলুর রহমান এমপি বলেন, ‘প্যারিস চুক্তি বিদ্যমান থাকলেও বিশ্ব সম্প্রদায়ের এখনও একটি দৃঢ় বোধের অভাব এবং এর বাস্তবায়নের জন্য একটি সত্যিকারের প্রতিশ্রুতির অভাব রয়েছে। যা একটি টেকসই আগামী এবং সবার জন্য একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজ নিশ্চিত করার জন্য অপরিহার্য।’
মীর মুস্তাক আহমেদ রবি এমপি বলেন, ‘কনফারেন্স অফ পার্টিজ-এর ফলাফলগুলো খুব বেশি ফলপ্রসু হয়নি। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে জলবায়ু পরিবর্তনের পরিণতিগুলো মোকাবিলার জন্য আমাদের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
ইঞ্জি. মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্মুখীন হচ্ছে, তবে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উচ্চ ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। তবে কার্বন নির্গমন হ্রাসের লক্ষ্যে পৌঁছাতে নবায়নযোগ্য শক্তি উদ্যোগের সম্প্রসারণ, বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য উন্নত প্রযুক্তি গ্রহণ, কম নির্গমন পরিবহনের ব্যবহার বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হবে।’
ফাইয়াজ মুর্শিদ কাজী বলেন, ‘ইউএনএফসিসির প্রাথমিক ফোকাস হওয়া উচিত নবায়নযোগ্য শক্তির উেসর দিকে বিনিয়োগ পুনর্নির্দেশিত করা এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করা। ইউক্রেনের সংঘাত জীবাশ্ম জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর ইউরোপের নির্ভরতার বিপত্তিকে উন্মোচিত করেছে।’
মাউরিজিও চিয়ান বলেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি। ইইউ সচেতন যে, এদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম এবং প্লাবনভূমির মতো অঞ্চলগুলো অর্থনৈতিকভাবে এবং জলবায়ুর দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।’
মারিয়া স্ট্রিডসম্যান বলেন, ‘বাংলাদেশের দুর্বল জনগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের বিধ্বংসী প্রভাবের খেসারত বহন করছে। এ প্রভাবগুলো মোকাবিলার জন্য স্টেকহোল্ডারদের নিজেদেরকে শিক্ষিত করতে এবং সমাধানগুলো প্রসারিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য অর্থায়নের উদ্যোগগুলো প্রয়োজনীয়।’
লুবনা ইয়াসমিন বলেন, ‘বিশ্বনেতাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় না থেকে তরুণদের জলবায়ু সংকট সমাধানে আরও সক্রিয় হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিছু অগ্রগতি থাকলেও এ সমস্যা সফলভাবে মোকাবিলা করার জন্য তহবিল এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র অবশ্যই আরও বৃদ্ধি করা উচিত।’
০